শওকত আলী মাথার হেলমেট ছুঁড়ে মারছেন আগুনে পুড়তে থাকা মোটরসাইকেলের গায়ে। মুখে অশ্রাব্য ভাষা, চোখে হাহাকার। পানি নিয়ে আগুন নেভাতে আসা মানুষকেও দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। কিছুটা পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ সদস্যের দিকে তাকিয়ে হাত-পা ছুঁড়ে চিৎকার করছেন, বলছেন মামলা দিতে। এই দৃশ্য গত ২৭ সেপ্টেম্বরের, রাজধানীর বাড্ডা লিংক রোডের। কিন্তু পাঠক একটু মনে করুন তো, এই ক্ষোভ, এই হতাশা কি রাইড শেয়ারে মোটরসাইকেল চালানো শওকত আলীর একার? আপনি, দেশের আর দশটা সাধারণ মানুষ, প্রতিদিন সকালে উঠেই যাদের নেমে পড়তে হয় জীবনযুদ্ধে, তাদের প্রত্যেকের ক্ষোভ কি একাকার হয়ে যায়নি শওকতের সাথে?

করোনা মহামারীর আঘাতে যে বিপুল সংখ্যক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা তাদের পুঁজির সবটুকু হারিয়েছেন শওকত তাদেরই একজন। বাংলাদেশ সরকার বড় গলায় তাদের জন্য প্রণোদনা ঘোষণা করেছিল। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা কেবল ঘোষণার মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে। শওকতরা প্রণোদনার ঋণের টাকা নিতে ব্যাংকে গিয়ে দেখেন টাকা তাদের কপালে নেই। শওকতরা বুঝতে পারেন, অনিয়ন্ত্রিত, অবৈধ ক্ষমতার দাপটে তারা পাওয়ার আগেই শেষ হয়ে গিয়েছে ঋণের টাকা। অথবা এতটাই জটিল সেই ঋণের সিন্দুক খোলার চাবি, যে স্বল্পশিক্ষিত শওকতরা তা গড়ে নিতে পারেননি। রাষ্ট্রের এমন অন্যায্যতায় শেষপর্যন্ত হতাশ হলেও এই শওকতরা কিন্তু সহজে ভেঙে পড়েন না। বরং নিজের শেষটুকু সম্বল নিয়েই নতুন স্বপ্ন দেখতে থাকেন, ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম শুরু করেন। কিন্তু তখনও এক অমানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থা তাকে ঘিরে ধরে, সেবা দেয়ার বদলে জরিমানা আদায়ে মেতে ওঠে তারা। তখনই শওকতরা হয়ে ওঠেন এমন আত্মবিধ্বংসী।

অর্থনীতিবিদ ড. আবুল বারকাতের গবেষণায় উঠে এসেছিল, করোনাকালে সবখাত মিলিয়ে প্রায় দেড় কোটির মতো মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছে। লকডাউনের সময়গুলোতে এই সংখ্যা আরও বেড়েছে সেটা অনুমান করে নেওয়াই যায়। এরপর কিছু মানুষ আবার কর্মক্ষেত্রে ফেরত এলেও শওকত আলীর মতো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী কিন্তু তা পারেননি। দারিদ্র্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু শওকতরা কোনো সহায়তা পাননি। পেলে হয়ত পরিস্থিতি সম্পূর্ণ অন্যরকম হতো। কিন্তু না পাওয়ায় তাদের চুক্তিতে যাত্রী নিয়ে মোটরসাইকেল চালানো ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল কি? 

আর শুধু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, নিম্নবিত্তের মানুষ কেন, আমাদের চাকরিপ্রত্যাশী তরুণ সমাজের অবস্থাও তো ভয়াবহ। দিনের পর দিন তাদের চাকরির পরীক্ষা আটকে ছিল। আর পরীক্ষা হলেই বা কী, চাকরির সুযোগই তো খুব কম। লাখ লাখ পরীক্ষার্থীর বিপরীতে পদ খালি থাকে মাত্র কয়েকশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপেই ভয়াবহতার চিত্র স্পষ্ট হয়েছে। উঠে এসেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজ থেকে পাস করা ৬৬ শতাংশ স্নাতকই বেকার থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। করোনায় অর্থনীতির ওপর পড়া বাড়তি চাপে এই পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। আর এই জটিলতার ফলাফল কী হচ্ছে? আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপ অনুযায়ী, করোনাকালে ১৫ মাসে ১৫১ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। গত ১৮ মাসে শুধুমাত্র ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে মোট ১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছেন। মনোবিদের ভাষায় বলতে গেলে এসব মৃত্যু কিংবা শওকত আলীর মোটরসাইকেলে আগুনের পেছনে ব্যক্তির মানসিক বিষণ্ণতাকেই দায়ী করা হবে। কিন্তু সেই মানসিক বিষণ্ণতার পেছনে যে সমাজে বিদ্যমান বৈষম্য, তীব্র আর্থিক অনটন, সুশাসনের অভাব, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের সহায়তায় সরকার, পরিবার এবং প্রতিষ্ঠানের তীব্র অবহেলা রয়েছে সেদিকেও নজর দেওয়াটা জরুরি। 

তাই শওকতের মোটরসাইকেলের এই আগুনকে কেবল একজন ব্যক্তির নিছক ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে দেখলে বড় ভুল হবে। কেননা এই ক্ষোভ আরও আত্মঘাতী হয়ে উঠতে  পারে। বরং এটা বুঝতে হবে যে, শওকত আলী সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের অধিকাংশ শ্রেণীর মানুষেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। তাদের একটি সুস্থ, স্বাভাবিক, স্বচ্ছল জীবন উপহার দিতে তাদের ক্ষোভের পেছনের প্রতিটি কারণকে তলিয়ে দেখতে হবে, খুঁজে বের করতে হবে সমাজে, অর্থনীতিতে কোন পরিস্থিতি তৈরি হলে এমন দুর্বিষহ হয়ে ওঠে মানুষের জীবন। 

এবার শওকত আলীর নির্দিষ্ট ঘটনায় দোর্দণ্ড প্রতাপশালী পুলিশ এবং সরকারি সেবা সংস্থাগুলোর ভূমিকাকে একটু বিশ্লেষণ করে দেখতে চাই। সপ্তাহখানেক আগে হওয়া আরেকটি মামলার রেশ কাটতে না কাটতেই শওকতের বিরুদ্ধে আবারও মামলা দিতে চলেছিল ট্রাফিক পুলিশ। দীর্ঘদিন ধরে বিশেষ করে নতুন সড়ক পরিবহন আইন আংশিক কার্যকর হওয়ার পর থেকেই মোটরসাইকেলের বিপরীতে মামলা দেওয়ার ব্যাপারে পুলিশের অতি উৎসাহ নিয়ে বারবার অভিযোগ উঠেছে। ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা বিষয়টি অস্বীকার করলেও পুরস্কৃত হওয়ার লোভে অনেক সময় পুলিশ কর্মকর্তারা মামলা করতে বেশি তৎপর থাকেন এমন একটি অভিযোগ অনেক চালককেই করতে দেখা যায়। অথচ বিপরীত আরেকটি চিত্র দেখুন, বাংলাদেশে গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারেরা মামলা করতে গেলে সময়মতো সেই মামলা না নেওয়ার কত শত অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে! ইদানীং তো পুলিশের পক্ষ থেকে সাংবাদিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে মামলা না করে আপোষে মিটিয়ে নেওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়। ঘটনাগুলো তুলনা করলে পুলিশের ব্যাপারে কয়েকটি সাধারণ ধারণা মানুষের মাঝে তৈরি হবে। এই যেমন চালকদের থেকে জরিমানা আদায়ে কোনো দক্ষতা প্রয়োজন হয় না। গুম হওয়া ব্যক্তিকে খুঁজে বের করতে দক্ষতা লাগে, ক্ষমতাশালী নির্যাতকের বিরুদ্ধে নির্যাতিতের পক্ষে দাঁড়াতে সততা, সাহস লাগে। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে জনগণের কাছে কী বার্তা যাচ্ছে সেটি তাই আরেকবার বাহিনীটিকে ভেবে দেখার পরামর্শ থাকবে।   

আবার, সড়কে সরকারি সেবার মান তেমন না বাড়লেও আইন ভঙ্গের অভিযোগে জরিমানা বাড়ার বিষয়টিও লক্ষ্যণীয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, নতুন সড়ক পরিবহন আইনে লাইসেন্স ব্যতীত যানবাহন চালানোর দণ্ড হিসেবে ৬ মাসের কারাদণ্ড বা ২৫ হাজার টাকার অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ডের কথা বলা আছে। এর আগে কার্যকর থাকা মোটরযান অধ্যাদেশ, ১৯৮৩ তে এই অপরাধে জরিমানার পরিমাণ ছিল ৫০০ টাকা। অর্থাৎ জরিমানার টাকা বেড়েছে ৫০ গুণ। অথচ লাইসেন্স সেবার মান কেমন বেড়েছে এই সময়ে? 

বিআরটিএ বিখ্যাত তার দালালচক্রের জন্য। দালাল ধরে নির্ধারিত ফির কয়েকশ গুণ অতিরিক্ত টাকা দিয়ে লাইসেন্স করানোর পদ্ধতিটি এখন সারা বাংলাদেশে নিয়মে পরিণত হয়েছে। ২০১৯ সালে দুদকও এই অভিযোগের সত্যতা পেয়েছিল। কিন্তু সরকার এই অনিয়ম বন্ধে কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এখনও লাইসেন্স করার জন্য অতিরিক্ত টাকা এবং ভোগান্তি গুণতে হচ্ছে মানুষকে। একই সাথে কেবল টাকার খেলায় জিতেই লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছেন অদক্ষ, অশিক্ষিত চালকেরা। 

এবার আসি পার্কিং এর মামলার কথায়। ঢাকা শহরে কয়টি জায়গায় নির্ধারিত পার্কিং এর ব্যবস্থা আছে? সরকার, সিটি করপোরেশন কয়টি পার্কিং স্পট তৈরি করেছে? পার্কিং স্পটের স্বল্পতার কথা খোদ ট্রাফিক পুলিশই স্বীকার করে। তাহলে রাস্তায় গাড়ি বা মোটরবাইক দাঁড়ানো দেখলেই অবৈধ পার্কিং এর মামলা কোন নৈতিকতার বলে দেয়া হয়? অবৈধ পার্কিং এর মতো অপরাধ দমন করা জরুরি, কিন্তু নিয়ম যাতে কাউকে ভঙ্গ করতে না হয়, সেই সুযোগ সুবিধা আগে তাকে দিতে হবে। তাই এই মামলা দেওয়ার আগে দেশের সকল বড় শহরেই পর্যাপ্ত সংখ্যক পার্কিং স্পট তৈরি করার উদ্যোগ নেওয়া সরকারের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়বে। সেই দায়িত্ব পালনের সদিচ্ছা কি সরকারের আছে?

এখন পর্যন্ত সদিচ্ছা থাকার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া না গেলেও, দ্রুত তা আনতে হবে। কেননা এদেশের জনগণ চায় বাংলাদেশ একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে উঠুক। কিন্তু অর্থ সংকটে থাকা কারও ওপর সরকারি প্রতিষ্ঠানের জরিমানার বোঝা চাপিয়ে দেওয়া মানবিক রাষ্ট্রের কাজ নয়। বেকার তরুণ-তরুণী, পুঁজি হারানো ব্যবসায়ীকে, বিপাকে থাকা উদ্যোক্তাকে ভুলে যাওয়া মানবিক রাষ্ট্রের কাজ নয়। অপরাধ দূর করার উপায় না খুঁজে, অপরাধীর শাস্তিতে মনোযোগ দেওয়া মানবিক রাষ্ট্রের কাজ নয়। মানবিক রাষ্ট্রের জন্য দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি, জরুরি সরকারি প্রতিটি প্রতিষ্ঠান, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বাহিনীকে জবাবদিহিতা, স্বচ্ছতার আওতায় নিয়ে আসা। মানবিক রাষ্ট্রের জন্য দেশের জনগণকে সেবা দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে কাজ করা জরুরি। তাদের শাসনের অভিপ্রায়, শাস্তি-জরিমানার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করার চেষ্টা জারি থাকলে আরও অনেক শওকত আলীর ক্ষোভ, হাহাকারে ভারী হয়ে উঠবে দেশের জনপদ।