গত ৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় কিশোরগঞ্জ ও গোপালগঞ্জের কয়েকটি উপজেলার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে যায়। বৈশাখ মাসের আগে আগে এমন ঝড় বাংলাদেশে স্বাভাবিক ঘটনা, আলাদা করে নজরে পড়ার মতো তেমন কিছু নয়। কিন্তু এই ঝড় শুধু কিছু গাছপালা উপড়ে শান্ত হয়নি, লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছে এসব এলাকার কৃষকদের জীবনও। ঝড় শুরুর কিছুক্ষণ পরেই শুরু হওয়া গরম বাতাসে নষ্ট হয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান। চলছে বোরোর মৌসুম, আর কিছুদিন পরই হয়ত এই ধানে ভরে উঠত কৃষকের গোলা। কিন্তু জমিতে এখন শুধুই চিটা। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট বলছে, ধানের জন্য ৩৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বা এর বেশি তাপমাত্রা অসহনীয়। ফুল ফোটার সময় এমন তাপমাত্রা থাকলে ধান চিটা হয়ে যায়। কিন্তু এমন গরম হাওয়া বিগত অনেক বছরের মধ্যে বইতে দেখা যায়নি। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে আমাদের কৃষকদের জীবনে। কিন্তু আমাদের কৃষকদের দুর্গতি কি শুধু এমন প্রাকৃতিক কারণেই ঘটছে?

প্রতিবছর নিয়ম করে বিভিন্ন ফসলের মৌসুমে আমাদের কৃষকদের জীবনে ঝড় নেমে আসে। মাসের পর মাস রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে অমানুষিক পরিশ্রম করে যে সোনার ফসল আমাদের কৃষকরা ফলায়, বিক্রির ঝুলিতে ওঠার সাথে সাথে তা দাম হারায়। চোখের জল ফেলতে ফেলতে উৎপাদন খরচ না উঠিয়েই বাড়ি ফিরতে হয় তাদের। কিন্তু তাদের ফলানো এসব ফসলই যখন খুচরা বাজারে ওঠে, শোনা যায় সাধারণ ক্রেতার দীর্ঘশ্বাস। দাম না পেয়ে ফলে কৃষক আরও গরিব হয়, ঋণের ভারে জর্জরিত হয়, তার সন্তান পেশা বদলে ফেলে। অথচ এমন শোষণ কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়েই আমরা গর্ব করি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের।    

চলমান করোনা মহামারীতেও রাষ্ট্রের সুনজর থেকে বঞ্চিত ছিল কৃষক। তাদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু আজ দশ মাস পর এসেও এর প্রায় ৩০ শতাংশ অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে। অথচ মহামারীতে কৃষকের দুর্দশার কথা কার অজানা? আমাদের ব্যাংকগুলো কৃষকদের ঋণ দিতে চায় না, আছে নানা রকম আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। আমাদের নিরক্ষর কৃষক বোঝে ফসলের কথা, মাটির কথা, ঋণের চুক্তিপত্র সে বোঝে না। এই বিষয়টি তো সরকার কিংবা আমলাদের অজানা নয়। তাদের উচিত ছিল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রণোদনার টাকা বিতরণের পরিবর্তে আরও সহজ পদ্ধতিতে সরাসরি কৃষকের হাতে নগদ টাকা পৌঁছে দেওয়া। কিন্তু তা করা হয়নি। করা হয়নি কেননা আমাদের সরকার কৃষকের কথা ভাবে না, ভাবে না কৃষকবান্ধব দেশের কথা। কেবল কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনিকে নিজেদের অর্জন বলে চালিয়ে নিতেই বেশি আগ্রহী আমরা।

সমস্যার শেকড় কোথায়?

বাংলাদেশের অধিকাংশ কৃষক ধান উৎপাদনে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। এর ফলও দেশ পাচ্ছে। বিশ্বের বুকে ধান উৎপাদনে আমরা বর্তমানে চতুর্থ। কিন্তু সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার এই ধানচাষীরাই। দেশের ধান চাল বিপণন ব্যবস্থায় এক বিরাট গলদ রয়েছে। অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালায় মূল্য নির্ধারণ থেকে শস্য সংগ্রহ - সব জায়গায় কৃষককে অবমূল্যায়ণ করা হয়েছে। এগুলো বরং অনেক বেশি ব্যবসায়ীবান্ধব। মৌসুমে সরকার সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে উৎপাদিত পুরো ধান সংগ্রহ করে না। বরং তারা নির্ভর করে চালকল মালিকদের ওপর। এই চালকল মালিকরা কৃষকের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে সিন্ডিকেট করে কম মূল্যে ধান কিনে নেয়। আবার এই ধানই অনেক বেশি মূল্যে সরকারের কাছে এবং চাল হিসেবে বাজারে বিক্রি করে। ফলে কৃষক ধানের দাম না পেলেও ভোক্তাকে বেশি দামেই চাল কিনতে হয়। আবার সরকার যে দামে ধান কেনে সেটাও বাস্তবসম্মত নয়। সরকারি এই দাম নির্ধারণে মূল্যস্ফীতি, স্থানভেদে উৎপাদন খরচের ভিন্নতা ইত্যাদি বিষয়কে বিবেচনায় নেয়া হয় না।

সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যেও ত্রুটি রয়ে গেছে। আমাদের সরকার এগুলো কেনে গুদামে নিজেদের মজুত বাড়াতে, যেন খাদ্য কেন্দ্রিক কোনো বিপর্যয়ের সময় তা সামাল দেয়া যায়। একারণে প্রতিবছর কয়েক কোটি টন ধান উৎপাদনের বিপরীতে সরকার সংগ্রহ করে মাত্র কয়েক লক্ষ টন। অথচ আমরা যদি পার্শ্ববর্তী পশ্চিমবঙ্গের দিকেও তাকাই, তাহলে দেখব সেখানে সরকারের ধান-চাল সংগ্রহের উদ্দেশ্যই থাকে কৃষককে সহায়তা করা। এ কারণে তারা সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান সংগ্রহ করে। ফলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমে। পরবর্তীতে চালকল মালিকদের সাথে চুক্তিতে সরকার সেসব ধান চালে পরিণত করে।

এরপরই আসে আমাদের দেশের অতিরিক্ত উৎপাদন খরচের কথা। আমাদের সরকার মূলত সার ও সেচপাম্পের বিদ্যুতে ভর্তুকি দেয়। কিন্তু উৎপাদন খরচ কমাতে ভর্তুকির এই পরিমাণ একেবারেই অপ্রতুল। অন্যান্য দেশ যেমন ভারতও সার, বীজ এবং বিদ্যুৎ সবকিছুতেই কৃষককে ভর্তুকি দেয়। ভর্তুকির পরিমাণও অনেকটা বেশি। ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসে। আর উৎপাদন খরচ কমলেই কৃষকের ক্ষতির সম্ভাবনাও কমে আসে।

কৃষককে দুর্যোগ পূর্ববর্তী, দুর্যোগকালীন এবং পরবর্তী সহায়তাতেও অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। বানের পানি থেকে ফসলি জমিগুলোকে রক্ষায় দেয়া বাঁধ নির্মাণে হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়। নিম্নমানের নির্মাণের কারণে প্রয়োজনের সময় অধিকাংশ বাঁধই ভেঙে পড়ে, নষ্ট হয় ফসলি জমি। কোন কারণে ফসল নষ্ট হলে কৃষকের কাছে সহায়তাও পৌঁছে না ঠিকভাবে। ব্যাংকগুলোকেও এসময় পাশে পাওয়া যায় না। দেশের নিরক্ষর কৃষকের মাত্র ২০ শতাংশ জানে কীভাবে ব্যাংক ঋণ নিতে হয়। তাই সহায়তা বা প্রণোদনা ঘোষণা করা হলেও বাকি ৮০ শতাংশ প্রান্তিক কৃষক এই সুবিধার বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর থেকেই কৃষি গবেষণায় যুগান্তকারী সাফল্য দেখিয়েছে। ধান ও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবদান এক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। কিন্তু প্রশাসনিক দক্ষতা ও সদিচ্ছার অভাবে এসব গবেষণার ফল দেশের প্রান্তিক ও ছোট কৃষকদের দ্বারে কমই পৌঁছায়। তারা এখনও সেই পুরনো পদ্ধতিতেই চাষ করে চলেছেন। আধুনিক প্রযুক্তি এবং পদ্ধতি ব্যবহার করে উৎপাদন বাড়ানো, দুর্যোগকালীন ক্ষতি কমানোর ব্যাপারে তারা ওয়াকিবহাল নন।

অভ্যন্তরীণ উৎপাদন এবং আমদানির মধ্যে সামঞ্জস্য বিধানে সরকারি ব্যর্থতা কৃষককে বিপদে ফেলে দিচ্ছে। প্রতিবছর পেঁয়াজ, আলুর মতো পণ্যের দাম না পেয়ে জমিতেই ফেলে রাখা কিংবা রাস্তায় ঢেলে প্রতিবাদ করা যেন আমাদের গা সওয়া হয়ে গিয়েছে। অথচ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন সম্পর্কে সঠিক তথ্য সংগ্রহ এবং সে অনুযায়ী আমদানির সিদ্ধান্ত নিলে দেশের কৃষকরা যেমন সঠিক মূল্য পেত, তেমনি খুচরা বাজারেও ক্রেতাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসতো।

কী করণীয়?

প্রথমেই কৃষককে অগ্রাধিকার দিয়ে আমাদের খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালায় পরিবর্তন আনতে হবে। মিল মালিকদের কাছ থেকে না কিনে সরাসরি কৃষকের উঠান থেকে সরকারকে ধান-গম সংগ্রহ করতে হবে। তারপর সরকারের কাছ থেকে মিল মালিকরা এগুলো সংগ্রহ করবে। আমরা জানি সরকারের গুদাম সংকট রয়েছে। কিন্তু এই অজুহাত কৃষককে ক্ষতিগ্রস্ত করার কারণ হতে পারে না। সরকারকে নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে বিপুল সংখ্যক সংরক্ষণাগার তৈরি করতে হবে। সাথে সাথে প্রতিবছর মূল্যস্ফীতি ও স্থানভেদে উৎপাদন খরচকে বিবেচনায় নিয়ে ধানের সংগ্রহমূল্য নির্ধারণ করতে হবে।

কৃষকের উৎপাদন খরচকে কমাতে হবে। এজন্য সার ও বিদ্যুতের সাথে সাথে বীজের ওপরও ভর্তুকি দিতে হবে এবং ভর্তুকির পরিমাণও বাড়াতে হবে। চাষের জন্য ঋণ সংগ্রহে কৃষককে যেন ভুগতে না হয় এজন্য সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। সহজ শর্তে কৃষককে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে কৃষি ব্যাংক বেশ কিছু সাফল্য দেখালেও তা যথেষ্ট নয়। সরকারি বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে কৃষি ঋণ প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। প্রয়োজনে চাষের মৌসুমে কৃষকের দোরগোড়ায় সহজে, কোন আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ছাড়াই যেন ঋণ পৌঁছে দেয়া যায় তেমন উদ্যোগ নিতে হবে।

কৃষি সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণে সবরকম দুর্নীতি দূর করতে হবে। হাওর অঞ্চলে বানের পানি রুখতে বাঁধ নির্মাণ, সংস্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণে স্থানীয় প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে আরও দক্ষতা ও আন্তরিকতার পরিচয় দিতে হবে।

জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি ও দুর্যোগের ক্ষতি থেকে কৃষককে রক্ষায় বিমার আওতায় নিয়ে আসা আরেকটি যুগান্তকারী উদ্যোগ হতে পারে। ভারত ও শ্রীলংকার মতো দেশগুলো তাদের কৃষককে বিমার আওতায় নিয়ে এসেছে। শুধু তাই নয়, এসব দেশে দরিদ্র কৃষকদের ৮০ শতাংশ প্রিমিয়ামও সরকারগুলো দিয়ে দেয়। আমাদের দেশেও জাতীয় দুর্যোগ তহবিল গঠন করে সকল কৃষককে বিমার আওতায় আনা যেতে পারে। এখানে বেসরকারি বিমা প্রতিষ্ঠানগুলোর সরকারি সহায়তার প্রয়োজন হবে। বিমাখাতে সরকার ভর্তুকিও দিতে পারে। এতে কৃষকের ক্ষতির ঝুঁকি যেমন কমবে, তেমনি কেবল ত্রাণনির্ভর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা থেকেও বের হয়ে আসা সহজ হবে।

কৃষিতে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। আধুনিক চাষ পদ্ধতি এবং যন্ত্রপাতির সাথে আমাদের কৃষকদের পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কিন্তু কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার কিছুটা ব্যয়বহুল। আমাদের দরিদ্র কৃষকদের পক্ষে এর ব্যবহার কীভাবে সম্ভব হবে? এর একটা সমাধান হতে পারে, সমবায় চাষ পদ্ধতি। আমাদের কৃষকরা ছোট ছোট জমিতে এককভাবে চাষ না করে পাশাপাশি জমির অনেকে মিলে চাষ করলে সম্মিলিতভাবে আধুনিক যন্ত্রের ব্যবহার সম্ভব হবে। এর ফলে ফলনও বাড়বে। তাই এমন সমবায় চাষ পদ্ধতি কৃষকদের মাঝে জনপ্রিয় করতে সরকারি কৃষি সংস্থাগুলোকে উদ্যোগ নিতে হবে, কৃষকদের কাছে এর উপকারিতা তুলে ধরতে হবে। একই সাথে দেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কৃষি গবেষণাকে আরও উৎসাহিত করতে হবে। কম খরচে কীভাবে ফলন বাড়ানো যায়, কীভাবে দেশীয় পদ্ধতিতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি তৈরি করা যায়, এমন বিষয়গুলো গবেষণায় বরাদ্দ বাড়াতে হবে।

কৃষকদের শোষণের কাঠামো জিইয়ে রেখে, জীবনমান উন্নত করার ব্যবস্থা না নিয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার চিন্তা করা হবে অবিবেচনাপ্রসূত। দেশের সংবিধানে কৃষক ও শ্রমিকের মুক্তির কথা জোর দিয়ে বলা হলেও এখনো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কৃষককে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখার প্রবণতা রয়ে গেছে। তা না হলে কেন কৃষককে রাস্তায় তার সোনার ফসল ঢেলে প্রতিবাদ জানাতে হয়? কেন গোলা ভরা ধান উৎপাদন করেও বাজার থেকে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফেরে কৃষক? আমাদের সরকারকে এগুলো ভাবতে হবে, ভাবতে হবে নাগরিকদেরও। আর শুধু ভেবে বসে থাকলে চলবে না, লড়তে হবে কৃষকের পক্ষে। নয়ত কৃষি ও কৃষকবান্ধব বাংলাদেশের প্রত্যাশা মরীচিকাই রয়ে যাবে।